বাংলাদেশের শেয়ারবাজারে দীর্ঘদিন ধরে চলমান পতন ও বিনিয়োগকারীদের আস্থাহীনতা এখন আরও জটিল ও গভীর সংকটে পরিণত হয়েছে। বারবার বৈঠক, পরামর্শ ও প্রতিশ্রুতি দিয়েও বাজারে ইতিবাচক কোনো স্থায়িত্ব আনা সম্ভব হয়নি। বাজার সাময়িকভাবে কখনো কখনো কিছুটা ঘুরে দাঁড়ালেও তা টিকে থাকছে না। বাজার সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ ও বিনিয়োগকারীদের মতে, এখন কেবল আশ্বাস দিয়ে আস্থা ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়; দরকার বাস্তব ও কার্যকর উদ্যোগ।
বৈঠকের আগের দিনের সাময়িক চাঙ্গাভাব
প্রধান উপদেষ্টার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিতব্য উচ্চপর্যায়ের শেয়ারবাজার সংক্রান্ত বৈঠকের আগের দিন, অর্থাৎ ৮ মার্চ (বৃহস্পতিবার), ঢাকা ও চট্টগ্রাম উভয় স্টক এক্সচেঞ্জেই কিছুটা চাঙ্গাভাব দেখা যায়। বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আশাবাদ তৈরি হয়—বৈঠকে হয়তো কিছু সাহসী ও তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত আসবে, যা বাজারকে ঘুরে দাঁড়াতে সহায়তা করবে।
বৈঠকের পাঁচ নির্দেশনা, বাস্তবায়ন দীর্ঘমেয়াদি
১১ মে (রোববার) অনুষ্ঠিত সেই বহুল আলোচিত বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা শেয়ারবাজার উন্নয়নে পাঁচ দফা নির্দেশনা প্রদান করেন। কিন্তু নির্দেশনাগুলোর প্রায় সবই ছিল কাঠামোগত ও দীর্ঘমেয়াদি সংস্কারভিত্তিক। যার ফলে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আশানুরূপ প্রভাব পড়ে না। বৈঠকের পরদিনই বাজার আবার পুরনো ধ্বসের ধারায় ফিরে যায়।
বৈঠকের পর বৈঠক, কিন্তু বাস্তবায়নে ঘাটতি
বাজার পরিস্থিতির ক্রমাবনতির প্রেক্ষিতে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ড. আনিসুজ্জামান চৌধুরী একাধিক জরুরি বৈঠকে বসেন। তিনি বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি), ঢাকা ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ এবং সিডিবিএল-এর প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনা করেন। এসব বৈঠকে বাজার স্থিতিশীলতায় করণীয় নির্ধারণ করা হলেও, বেশিরভাগ পদক্ষেপই ছিল মধ্যমেয়াদি বা দীর্ঘমেয়াদি। ফলে বাজারে তাৎক্ষণিক কোনো পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়নি।
ব্রোকারদের দাবি: প্রয়োজন তাৎক্ষণিক প্রণোদনা
পরবর্তী সময়ে ডিএসই কার্যালয়ে স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে বৈঠকে ড. আনিসুজ্জামান চৌধুরী ফের আশ্বাস দেন, শেয়ারবাজারে আস্থা ফেরাতে প্রয়োজনীয় সকল উদ্যোগ নেওয়া হবে। কিন্তু ব্রোকারেজ হাউজের প্রতিনিধিরা স্পষ্ট ভাষায় বলেন, কেবল আশ্বাস যথেষ্ট নয়। তারা সরকারের কাছে দাবিও জানান—বিও হিসাব ফি মওকুফ, মূলধন লাভ কর অব্যাহতি, ব্রোকার কমিশন হ্রাস, ডিভিডেন্ড কর অব্যাহতি, এবং অগ্রিম আয়কর হ্রাস। এসব পদক্ষেপ বাস্তবায়ন না হলে বাজারে বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরবে না।
হঠাৎ আশার আলো, দ্রুতই ফের হতাশা
১৯ মে (সোমবার) লেনদেন শুরুর পর বাজারে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। সূচক শুরুতে স্থিতিশীল থাকলেও পরে তা ধীরে ধীরে নিচের দিকে নামতে থাকে। এমন সময় সংবাদমাধ্যমে খবর আসে, বিএসইসি চেয়ারম্যান খন্দকার রাশেদ মাকসুদ প্রধান উপদেষ্টার দেওয়া নির্দেশনার অগ্রগতি নিয়ে অর্থ উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক করছেন। এই খবর বাজারে কিছুটা স্বস্তির আবহ তৈরি করে, সূচক ঘুরে দাঁড়ায় এবং সাময়িক চাঙ্গাভাবও লক্ষ্য করা যায়।
তবে বড় বিনিয়োগকারী বা ব্রোকার হাউজগুলোর পক্ষ থেকে প্রত্যাশিত সহায়তা না আসায় বাজারে এই ইতিবাচক ধারা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। দুপুরের পর সূচক আবার নেতিবাচক মোড় নেয় এবং দিনের শেষে তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
সতর্কবার্তা: “এবার না জাগলে সর্বনাশ অনিবার্য”
বাজার বিশ্লেষক ও সংশ্লিষ্টরা সতর্ক করে বলছেন—এখন আর সময় নষ্ট করার সুযোগ নেই। শুধু নিয়ন্ত্রক সংস্থা, বিনিয়োগকারী বা ব্রোকারদের উদ্যোগে শেয়ারবাজারের সংকট কাটানো সম্ভব নয়। সরকারকে সরাসরি সহায়তা দিতে হবে, নিতে হবে দৃশ্যমান ও বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ। প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী, ব্রোকারেজ হাউজ এবং সরকারের মধ্যে সমন্বিত পদক্ষেপ ছাড়া এই সংকট উত্তরণ সম্ভব নয়।
তাদের মতে, যদি এখনই সুনির্দিষ্ট ও কার্যকর নীতি সহায়তা না আসে, তাহলে শেয়ারবাজার ব্যবস্থার ওপর বিনিয়োগকারীদের আস্থা পুরোপুরি উঠে যাবে। ফলে অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ খাত ধীরে ধীরে অচল হয়ে পড়বে, যার প্রভাব পড়বে জাতীয় অর্থনীতির ওপরও।