জাতীয় ঐকমত্য কমিশন সংবিধানসহ রাষ্ট্র সংস্কারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ধারাবাহিক সংলাপ করছে। এ প্রক্রিয়ায় সংবিধান সংস্কার, বিচার বিভাগ, নির্বাচন ব্যবস্থা, জনপ্রশাসন ও দুর্নীতি দমনসংক্রান্ত পাঁচটি সংস্কার কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতে ১৬৬টি প্রশ্ন সম্বলিত স্প্রেডশিট আকারে প্রস্তাব পাঠানো হয় ৩৯টি দল ও জোটের কাছে। এদের মধ্যে ৩৫টি সাড়া দিয়েছে।
২০ মার্চ এলডিপির সঙ্গে সংলাপের মধ্য দিয়ে প্রক্রিয়া শুরু হয় এবং ১৫ মে’র মধ্যে প্রথম ধাপের সংলাপ শেষ করার পরিকল্পনা রয়েছে। এখন পর্যন্ত ২৫টি দল ও জোটের সঙ্গে সংলাপ সম্পন্ন হয়েছে। কমিশনের পক্ষ থেকে সংলাপে নেতৃত্ব দিচ্ছেন সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে ঐকমত্য, কিন্তু মেয়াদ ও গঠন নিয়ে ভিন্নমত
সব রাজনৈতিক দল তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার পক্ষে থাকলেও মেয়াদ নিয়ে বিভক্তি রয়েছে। সংবিধান সংস্কার কমিশন তিন মাস ও নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন চার মাস মেয়াদের প্রস্তাব দিয়েছে। তবে প্রধান, সদস্য সংখ্যা ও নিয়োগ পদ্ধতি নিয়ে মতভেদ রয়ে গেছে।
দ্বিপক্ষ বিশিষ্ট সংসদ গঠন নিয়ে সহমত, তবে উচ্চকক্ষের কাঠামো নিয়ে মতপার্থক্য
সংলাপে অংশ নেওয়া দলগুলোর অধিকাংশ দ্বিপক্ষবিশিষ্ট সংসদের পক্ষে মত দিলেও উচ্চকক্ষের সদস্য সংখ্যা ও প্রতিনিধিত্ব নির্বাচন প্রক্রিয়া নিয়ে ঐক্যমত নেই।
প্রধানমন্ত্রী-পদ বিভাজন বিষয়ে ভিন্নমত
সংসদ নেতা, প্রধানমন্ত্রী ও দলীয় সভাপতির পদ একই ব্যক্তির না হওয়া উচিত — এমন সুপারিশে বিএনপি একমত নয়। তারা প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতার পদ একই ব্যক্তির হাতে রাখার পক্ষে এবং বিষয়টি সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের ওপর ছেড়ে দিতে চায়। এনসিপি এই পদগুলো আলাদা করার পক্ষে এবং জামায়াত এ বিষয়ে এখনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়নি।
ক্ষমতার ভারসাম্য ও জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি) নিয়ে মতপার্থক্য
বিএনপি প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য আনার প্রস্তাবের কিছু অংশে দ্বিমত পোষণ করেছে। ‘জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল’ গঠনের প্রস্তাব তারা প্রত্যাখ্যান করেছে। এনসিপি ও জামায়াত এই প্রস্তাবের পক্ষে। বিএনপির আশঙ্কা, এটি দ্বৈত শাসনব্যবস্থা তৈরি করবে এবং প্রধানমন্ত্রীর নির্বাহী ক্ষমতা হ্রাস পাবে।
প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ ও বয়সসীমা নিয়ে বিভক্তি
প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ নিয়ে কমিশনের প্রস্তাবে বিএনপি কিছুটা নমনীয়তা দেখিয়েছে। তারা সর্বোচ্চ তিন মেয়াদের পক্ষে, যার মধ্যে টানা দুই মেয়াদ এবং একটি বিরতি দিয়ে তৃতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হওয়া যাবে। বিএনপি ও জামায়াত মেয়াদ পাঁচ বছর করতে চায়, তবে এনসিপি চার বছরের প্রস্তাবকে সমর্থন করেছে।
সংবিধানের প্রস্তাবনায় ধর্ম ও বহুত্ববাদ নিয়ে মতানৈক্য
বিএনপি, জামায়াত ও ইসলামি দলগুলো সংবিধানের প্রস্তাবনায় ‘বহুত্ববাদ’ যুক্ত করার ঘোর বিরোধিতা করেছে। তারা ২০১১ সালের পঞ্চদশ সংশোধনীর আগের অবস্থায় ফিরে ‘সর্বশক্তিমান আল্লাহর প্রতি পূর্ণ বিশ্বাস’ বাক্যটি ফেরানোর পক্ষে। জামায়াত ‘বহুসংস্কৃতিবাদ’ যুক্ত করার প্রস্তাব দিয়েছে এবং এনসিপি মনে করে ‘বহুত্ববাদ’ শব্দের বাংলা অনুবাদ আরো স্পষ্ট করা উচিত।
বিচার বিভাগে সংস্কার ও প্রধান বিচারপতি নিয়োগে মতপার্থক্য
বিএনপি প্রধান বিচারপতির পদে তিনজন জ্যেষ্ঠ বিচারপতির মধ্য থেকে বাছাইয়ের পক্ষে, যেখানে কমিশন আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠতম বিচারপতির নাম প্রস্তাব করেছে। বিএনপি একটি ‘জুডিশিয়াল অ্যাপয়েন্টমেন্ট কমিশন’ গঠনের প্রস্তাব দিলেও এর কাঠামো সংসদে আলোচনার মাধ্যমে নির্ধারণ করতে চায়। জামায়াত ও এনসিপি কমিশনের প্রস্তাবের পক্ষে মত দিয়েছে।
সংবিধান সংশোধনের অন্যান্য প্রস্তাবে বিএনপির আপত্তি
বিএনপি সংবিধান সংশোধনের প্রক্রিয়ায় গণভোট, রাষ্ট্রপতি নির্বাচন পদ্ধতি, জরুরি অবস্থা জারি, মৌলিক অধিকার ও স্বাধীনতার আলাদা অধ্যায়, দেশের নাম পরিবর্তন, সংসদে তরুণদের জন্য ১০ শতাংশ আসনে মনোনয়ন এবং প্রার্থীর ন্যূনতম বয়স ২১ বছর করার প্রস্তাবগুলো প্রত্যাখ্যান করেছে।
জাতীয় ঐকমত্যের আহ্বান
কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ রাজনৈতিক দলগুলোকে ছাড় দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেন, সব বিষয়ে একমত হওয়া সম্ভব না হলেও রাষ্ট্র গঠনের মৌলিক জায়গায় ঐকমত্য জরুরি। কমিশনের সদস্য ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেছেন, দলগুলোর নিজস্ব অবস্থান থাকাই স্বাভাবিক, তবে সবাইকে একত্রিত করাই এখন চ্যালেঞ্জ।
সূত্র:আমার দেশ