দুপুর গড়িয়ে বিকেল। একটা ছিপছিপে জিপ। এয়ারপোর্ট থেকে দ্রুত বের হয়ে গেল। গন্তব্য শাহবাগ। হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল। গাড়িটির পেছনের সিটে দু'পাশের গ্লাস খোলা। খোলা জানালায় বেরিয়ে আছে দু'টি স্টেনগানের নল। পেছনের সিটে দুজন রক্ষী উঠিয়ে রেখেছে অস্ত্রগুলো। নেতা হোটেলে নামলেন। সামরিক প্রহরায় থাকলেন, যাতায়াত করলেন প্রেসিডেন্ট ভবনে তাও সামরিক প্রহরায়।
কারণ প্রেসিডেন্টের অনেক অনুরোধে জুলফিকার আলী ভুট্টো ঝুঁকি নিয়ে আলোচনার জন্য ঢাকা এসেছেন। দিনটি ১৮ই মার্চ ১৯৭১। জেড.এ. ভুট্টোকে তো আপনারা সবাই চেনেন। পাকিস্তানের অভিজাত জমিদার পরিবারে তার জন্ম। মাত্র ১৩ বছর বয়সে অভিভাবকরা মামাতো বোনের সাথে তার বিয়ে দেন। মামাতো বোনের বয়স ছিল তেইশ। ভুট্টোর চেয়ে মাত্র ১০ বছরের বড়। 'স্ত্রী' বস্তুটা কি? তার প্রয়োজনই বা কি? তা তখনও বুঝতেন না তিনি। তাই বিয়ের দিন ক্রিকেট খেলতে যাবার তাড়া ছিল। দুটি নতুন ব্যাট পাবার আশায় যদিওবা বিয়ের অনুষ্ঠানে চুপচাপ ছিলেন। অনুষ্ঠান শেষে দৌড়ে পালিয়েছিলেন খেলার মাঠে। ১০ বছর কেটে গেল। ভুট্টো তখন ২৩ বছরের টগবগে যুবক। ইংল্যান্ডে পড়তে যেয়ে দেখা হল ইরানী মেয়ে নুসরাতের সাথে। মজার ব্যাপার হলো ঐ সময়ে জহরলাল নেহেরুর কন্যা ইন্দিরা গান্ধীও তখন অক্সফোর্ডের শিক্ষার্থী। ভুট্টোর ক্লাসমেট। ইন্দিরা অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে বিস্তারিত নোট নিতেন। ভুট্টো তাকে প্রশ্ন করতো "আপনি কি নোট নিচ্ছেন, না থিসিস লিখছেন?" ইন্দিরা সম্পর্কে ভুট্টো বলেন, "তিনি আমাকে আকৃষ্ট করতে পারেননি। নেহেরুর মেয়ে না হলে তিনি প্রধানমন্ত্রী হতে পারতেন না" ইত্যাদি। যাহোক, নুসরাত দেখতে খুবই সুন্দরী এবং ভদ্র মেয়ে ছিল। দুটো এই ইরানী কন্যার প্রেমে পড়লেন। বিবাহের জন্য নুসরাতকে রাজী করাতে যথেষ্ট বেগ পেতে হলো তার। কারণ ভুট্টোর ২য় স্ত্রী হতে সে অসম্মত। পরে "তাতে কি", "বাদ দাও ওসব" বাক্য দুটি শুনে নুসরাত মত পাল্টান, ভুট্টোর ২য় স্ত্রী হিসেবে 'করুন বললেন ইরানী কন্যা। তার গর্তেই ভুট্টোর চার সন্তানের জন্ম। ভুট্টো তুখোর বক্তা, গ্রন্থ রচয়িতা এবং যিনি উর্দুর চেয়ে ভাল ইংরেজী কনতে পারেন। তার দীক্ষাগুরু ছিলেন 'চৌ এন লাই'। যখন তিনি সামরিক হেলিকপ্টারে উঠে কোথাও যান, তখন তার মাথায় থাকে একটা ক্যাপ। সেটি চৌ এন লাই এর দেয়া। একার হালার (একটি স্থান) জন সমাবেশে, রাজপুত্রের মতো তিনি মঞ্চে বসে আছেন। একজন দরিদ্র লোক মঞ্চে নিয়ে এল একটা 'ছাগল'। ছাগলটিকে সুন্দর করে রঙিন কাপড় দিয়ে সাজানো হয়েছে। গলায় পরানো হয়েছে সু-সজ্জিত মালা। এটি আনা হয়েছে ভুট্টোর সম্মানে জবাই করার জন্য। তার সম্পর্কে এসব গল্প তিনি নিজেই করেছিলেন এক সাক্ষাৎকারে। [সূত্র: ইন্টারভিউ উইথ হিস্টরী ওরিয়ানা ফালাচী-অনুবাদ আনোয়ার হোসাইন মঞ্জু ৫-৫৬ পৃষ্ঠা)
১৭০ এর নির্বাচনে দুটোর পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি) পশ্চিম পাকিস্তানে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। পশ্চিম পাকিস্তানীয় জাতীয় পরিষদে নির্বাচন হয়েছিল ১৩৮টি আসনে। তিনি পেয়েছিলেন ৮১টি আসন। পূর্ব পাকিস্তানে আ'লীগ পেয়েছিল ১৫১টি আসন। মালুম জননেতা মাওলানা ভাসানী আ'লীগের সভাপতিত্ব ছেড়ে ন্যাপ গড়েছিলেন। ন্যাপ ঐ নির্বাচন বয়কট করেছিল তাই এ প্রদেশে আ'লীগের কোন শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল না। নির্বাচনের পর ক্ষমতা হস্তান্তরে ভুট্টোর আপত্তিার মন্তব্য আচরনে সংকট তৈরী হয়। সংকট ক্রমেই গুরুতর হয়ে ওঠে। ভোটের ফল প্রকাশের পরেই তিনি বলে বসলেন 'গত ২৩ বছর পূর্ব পাকিস্থান দেশ শাসনে ন্যায্য হিস্যা পায়নি। তাই বলে আগামী ২৩ বছর পশ্চিম পাকিস্থানের উপর প্রভুত্ব করবে তা হতে পারে না।" (সূত্র: রাজনীতির চার দশক, আবদুল হক, পৃষ্ঠা-১৮০]
তিনি 'জাতীয় পরিষদ' কে কসাইখানা হিসেবে উল্লেখ করলেন এবং বললেন 'দেশে তিনটি পার্টি রয়েছে, আ'লীগ, পিপিপি ও সামরিক বাহিনী।" এ বক্তব্যের মাধ্যমে তিনি সামরিক হস্তক্ষেপকে উস্কে দিলেন। আর বাঙালকে দেখানেন হাইকোর্ট। (প্রাগুক্ত- পৃঃ ১৮৬)শুধু তাই নয় পিপলস পার্টির জাতীয় পরিষদের সকল সদস্য একযোগে পদত্যাগের হুমকি দিলেন এবং পূর্ব পাকিস্তানে অধীবেশনে আসতে অস্বীকৃতি জানালেন। তার এই অসহযোগীতায় ২ বার জাতীয় পরিষদের অধীনেশন স্থগিত হল। প্রথমবার ৩রা মার্চ। দ্বিতীয়বার ২৫ শে মার্চ। ইয়াহিয়া খান ভুট্টোকে ডেকে পাঠালেন পূর্ব পাকিস্তানে। উত্তরে তিনি জানালেন ঢাকায় এসে কোন লাভ হবে না। কাজেই তিনি আসবেন না। তাছাড়া ঢাকায় নিরাপত্তারও যথেষ্ট অভাব রয়েছে। প্রভৃতি। পরিশেষে অবশ্য তিনি এসেছিলেন, গোধুলি বেলায়। সেই জানালা খোলা জিপটিতে করে। (প্রাগুক্ত-১৯৭ পৃষ্ঠা) তার গল্পটা আসলে সেই স্কুল পালানো ছেলেটির পিতার মত। একদিন দুষ্ট ছেলে স্কুল পালিয়ে বাড়ীতে এসে বলে, "সে আর পড়াশুনা করবে না"। পিতা তাকে নিয়ে ক্লাসে গেলেন। ক্লাস টিচারকে বললেন, "কাল থেকে ওকে ৫ম শ্রেণী থেকে ৪র্থ শ্রেণীতে নামিয়ে দেবেন। এরপরের বছর তৃতীয় শ্রেণীতে। তারপর ২য় এবং পরের বছর ১ম শ্রেণী। এভাবেই তাকে লেখাপড়া ছাড়তে হবে। আমার পয়সা খরচ করে সে যে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত উঠেছে। নামতে গেলে সেসব ক্লাশ পুনরায় শেষ করেই তাকে স্কুল ছাড়তে হবে। "লোকটির কথা শুনে ক্লাসশুদ্ধ সবাই হেসে উঠল। যাহোক, ঢাকায় এসে মুজিব-ইয়াহিয়া-ভুট্টো অনেক গোপন বৈঠক, রুদ্ধদ্ধার বৈঠক হল। ৬দফা মানা না মানার প্রশ্নে সব ভেঙে যাচ্ছিল। প্রথমে ২টি পরে ৪টি দফা মানতে রাজি হলেন ভুট্টো। মুজিব ৬ দফার উপর অনঢ় রইলেন। অনেকেই মনে করেন, সে সময়ে, গণতন্ত্রীপন্থি দুই দল, মুজিল-ভুট্টো যদি একমত হতেন তাহলে সামরিক নিপীড়ক ইয়াহিয়া টিকতে পারত না। আইয়ুব খান টিকতে পারেননি। দেশ ভাঙতো না, টিকে যেতো পাকিস্তান।
শেষমেষ ভুট্টোকে বোকা বানিয়ে ছাড়ল, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া। ভুট্টো বুঝতেই পারেনি, আলোচনা চলমান অবস্থায় তাকে একা রেখে ইয়াহিয়া চলে যেতে পারেন। কারণ ২৬ মার্চণ্ড তার সাথে একটা এপয়েন্টমেন্ট দিয়ে রেখেছেন ইয়াহিয়া। ২৫ শে মার্চ সন্ধ্যা রাতে, শেখ মুজিবের একান্ত সচিব জমির উদ্দীনের মুখে শোনেন প্রথম খবরটি। জমির এসেছেন, মুজিবের "এধারকা আমার, ধারকা তোমার মার্কা কনফেডারেশনের প্রস্তাবের উত্তর নিতে। জমিরকে দুটো কালেন, "আগামীকাল (২৬ শে মার্চ ৭১) ইয়াহিয়া মুজিবের সাথে কথা কলবেন। উত্তরে জমির তাকে জানালেন ইয়াহিয়া ইতিমধ্যে ঢাকা ত্যাগ করেছে। জমিরের উত্তরে উদ্ধিন্ন হলেন ভুট্টো। সঙ্গে সঙ্গে প্রেসিডেন্টের বাসভবনে ফোন করলেন, তারা বলল, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া, চিকা খানের সাথে নৈশভোজে বসেছেন তাকে এখন ডিস্টাব করা যাবে না। ভুট্টো তখন টিকা কে ফোন করুন। চিত্তাখানেরও একই জবাব, ডিস্টাব করা যাবে না। জমির বিদায় নিলে উৎকণ্ঠা নিয়ে ভুট্টো রাতের খাবার খেলেন। ঘুমুতে মেলেন, হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে (শেরাটন) উঁচু বনায় তার ৯৯১ নম্বর স্যুটে। মধ্যরাতে গুলির শব্দে তার ঘুম ভাঙল। দৌড়ে জানালার কাছে গেলেন। জানালা খুলে তিনি কাঁদলেন, কান্নাজড়িত কণ্ঠে বিড়বিড় করে কনলেন "আমার দেশাটা শেষ হয়ে গেল।" দেখলেন রাস্তায় সেনাবাহিনী নেমেছে। বিরোধী দলীয় সংবাদপত্র 'পিপন' এর অফিসটি ভেঙে ফেলছে সৈন্যরা। ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলটি ঘিরে রেখেছে বেশ কিছু ট্যাংক। সৈন্যরা লাউড স্পীকারে সবাইকে সরে যেতে বলছে।
যারা ধরা পড়ছে তাদের দাঁড় করানো হচ্ছে মেশিনগানের মুখে। (সূত্র: দুই পলাশীর দুই আম্রকানন-কে এম আমিনুল হক, পৃষ্ঠা ৩৮২) সেদিন থেকেই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধটা শুরু হল। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ। যুদ্ধের শেষ দিকে। জাতিসংঘের এক অধিবেশনে, অদ্ভুত ঘটনার অবতারণা করলেন ভুট্টো। বক্তৃতা করতে যেয়ে ভাবাবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেন না। আবারও তিনি কাঁদলেন। ক্রোধে, বিরক্তিতে সকলকে জাহান্নামে যাওয়ার অভিশাপ দিলেন। পোল্যান্ডের প্রস্তাবটি ছিড়ে আবর্জনার স্লপে চুড়ে ফেললেন। রেগে অধিবেশন কক্ষ থেকে বের হয়ে গেলেন। শ্রীনাথ রাঘব বলেন একেবারে শেষ মুহূর্তে ভুট্টো যদি এ কাজটি না করতেন, তাহলে "ভারতীয় বাহিনীকে ঢাকার
অনেক আগেই থেমে যেতে হতো। তাহলে নিঃশূর্ত আত্মসমর্পণ কিংবা ৯৩ হাজার সেনা যুদ্ধবন্দী হতো না।"
(সূত্র: ১৯৭১ আ গ্লোবাল হিস্টরি অব দ্য ক্রিয়েশন অব বাংলাদেশ (২০১৩)
যুদ্ধ শেষ হলো। স্বাধীন হলো প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ। বিমর্ষ ইয়াহিয়া ও সেনাবাহিনী ভুট্টোর হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দিল। ভুট্টো এখন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট এবং সামরিক আইন প্রশাসক। বন্দী অবস্থায় শেখ মুজিবকে নায়ালপুর থেকে রাওয়ালপিন্ডিতে আনা হলো। ভুট্টোর নির্দেশে তার সাথে সাক্ষাতের জন্য। ভুট্টো একটি রেডিও ১টি টিভি এবং বেশকিছু কাপড়-চোপড় নিয়ে নির্দিষ্ট বাংলোতে গেলেন, শেখ মুজিবের সাথে দেখা করতে। শেখ সাহেব জানতেন না যে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। অবশ্য ব্লাক আউট ও যুদ্ধ বিমানের গর্জন থেকে তিনি যুদ্ধ সম্পর্কে আঁচ করেছেন। ভুট্টো, শেখ মুজিবকে মুক্ত ঘোষণা করলেন। মুক্ত মুজিব আন্তরিক পরিবেশে, কোরআন স্পর্শ করে ভুট্টোর কাছে প্রতিজ্ঞা করলেন, তিনি পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে সম্পর্ক রক্ষা করবেন। ৮ই জানুয়ারি ১৯৭২ ভোর ৩টা, ভুট্টো ইসলামাবাদ বিমান বন্দরে যান শেখ মুজিবকে বিদায় জানাতে। মুজিব, ভুট্টোর বুকে বুক মেলালেন। বললেন, "মি: প্রেসিডেন্ট। আমি শীঘ্রই আসবো।" তিনি কথা রেখেছিলেন। বাংলাদেশে এসে লাল গালিচা সংবর্ধনা নিয়েছিলেন, স্বাধীনতার স্মৃতি সৌধে দিয়েছিলে পুষ্প স্থাবক।
নিন্দার কাঁটা ও আদর্শবাদী এক্টিভিজম - ওয়াজ কুরুনী সিদ্দিকী
কা'বা দর্শণ আল্লাহর এক নিয়ামত : অধ্যাপক আবুল খায়ের নাঈমুদ্দীন
যাকাত ও সাদাকা : দারিদ্র্য বিমোচনের মানবিক সমাধান
যাকাতের মাধ্যমেই দেশ হতে পারে স্বনির্ভর - আবুল খায়ের নাঈমুদ্দীন