যুক্তরাষ্ট্রের একটি বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী কোম্পানিকে ২০ মিলিয়ন ডলার ক্ষতিপূরণ দিয়ে দীর্ঘদিনের মামলা নিষ্পত্তি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।
গত বছর যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে এই মামলায় গ্রেপ্তার হওয়ার আশঙ্কায় পড়েছিলেন অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর।
এর মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের স্মিথ কোজেনারেশন ইন্টারন্যাশনালের সহযোগী প্রতিষ্ঠান স্মিথ কো-জেনারেশন (বাংলাদেশ) প্রাইভেট লিমিটেডের সঙ্গে সরকারের দীর্ঘ দিনের বিরোধ নিষ্পত্তি হতে যাচ্ছে। আদালতের বাইরে মধ্যস্থতার মাধ্যমে মামলাটি রফা করেছে বিদ্যুৎ বিভাগ। শর্ত হচ্ছে, এই অর্থ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কোম্পানিটি বাংলাদেশ সরকারের নামে যেসব মামলা করেছে, সেগুলো প্রত্যাহার করা নেবে।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান গতকাল (৩০ এপ্রিল) মোবাইলফোনে টিবিএসকে বলেন, অর্থনৈতিক বিষয়-সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটি বিদ্যুৎ বিভাগের অনুরোধ করা অর্থ সরবরাহের অনুমোদন দিয়েছে।
'কোম্পানিটি সুইজারল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ অনেকগুলো দেশের আদালতে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে মামলা করেছে। এখন একটা একস্ক্রো অ্যাকাউন্ট খোলা হবে। সেখানে টাকাটা থাকবে। এরপর ওই কোম্পানি বাংলাদেশের নামে যত মামলা করেছে, সেগুলো সব প্রত্যাহার করলে এবং আইনজীবী সার্টিফাই করলে টাকাটা কোম্পানির অনুকূলে ছাড় হবে,' বলেন তিনি।
বিদ্যুৎ উপদেষ্টা বলেন, কোম্পানিটির মামলার কারণে আশুগঞ্জ বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ বাংলাদেশের অনেকগুলো প্রকল্পের মালামাল আমদানি আটকে আছে।
তিনি বলেন, 'এক্ষেত্রে বাংলাদেশের দুর্বলতা ছিলো। যখন কোম্পানিটি আরবিট্রেশনে গেছে, তখন বাংলাদেশ সেখানে আইনজীবী নিয়োগ করেনি। ফলে আরবিট্রেশন থেকে রায় তাদের পক্ষে গেছে।'
বিবাদ
বিদ্যুৎ বিভাগের এক প্রতিবেদন অনুসারে, ১৯৯৭ সালে ঠাকুরগাঁওয়ের হরিপুরে ১০০ মেগাওয়াট সক্ষমতার বার্জ-মাউন্টেড বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের জন্য স্মিথ কো-জেনারেশন (বাংলাদেশ) প্রাইভেট লিমিটেডের সঙ্গে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি) ও বাংলাদেশ সরকারের চুক্তি হয়।
ওই বছরেই বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি ও বাস্তবায়ন চুক্তি স্বাক্ষর হয়। চুক্তি অনুযায়ী, ১০ মাসে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করার কথা ছিল ওই কোম্পানির। আর বাণিজ্যিক ভিত্তিতে বিদ্যুৎ উৎপাদনের কথা ছিল ১৯৯৮ সালের ১৫ আগস্ট থেকে।
কোম্পানিটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে বিদ্যুৎকেন্র স্থাপনে, এমনকি সাইটে কোনো নির্মাণকাজ শুরু করতেও ব্যর্থ হয়। তারপর কোম্পানিটি নির্ধারিত সময়সীমা আরও ৬ মাস ২০ দিন বাড়ানোর জন্য একটি সাপ্লিমেন্টারি চুক্তি স্বাক্ষরের প্রস্তাব দেয়।
কিন্তু সরকার সেই চুক্তি না করে নির্ধারিত সময়ে ও শর্তে কাজ না করায় ১৯৯৯ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি বাতিল করে। পাশাপাশি কোম্পানিটির পারফরম্যান্স ব্যাংক গ্যারান্টির ১ লাখ ৫০ হাজার ডলার বিপিডিবির অনুকূলে নগদায়ন করা হয়।
এরপর বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি ও সংশ্লিষ্ট ল্যান্ড লিজ চুক্তি বাতিলের বিরুদ্ধে কোম্পানিটি ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের সাব-জজ আদালতে মামলা করে। তবে পরে ওই মামলা খারিজ হয়ে যায়।
বাংলাদেশের আদালতে মামলা দায়েরের পাশাপাশি কোম্পানিটি আইসিসি আরবিট্রেশনের অধীনে চুক্তি বাতিল ও পারফরম্যান্স ব্যাংক গ্যারান্টি নগদায়নের বিরুদ্ধে আপত্তি উত্থাপন করে আরবিট্রেশনের জন্য ১৯৯৯ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বিপিডিবিকে নোটিশ পাঠায়। ওই নোটিশের পর বিপিডিবি আজমালুল হোসেন কিউসি-কে আরবিট্রেটর হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার উদ্দেশ্যে চিঠি পাঠায়।
বিদেশে আরবিট্রেশন মামলায় অংশগ্রহণের জন্য আইসিসি ট্রাইব্যুনাল খরচ বাবদ মোট ৯ লাখ ৫০ হাজার ডলার নির্ধারণ করে, যা উভয় পক্ষকে সমানভাবে বহন করতে হবে। এর মধ্যে ১.২০ লাখ ডলার আগাম দিতে হবে। এতে প্রাথমিকভাবে বিপিডিবির ৬০ হাজার ডলার পরিশোধ করতে হতো।
এই বিপুল অঙ্কের ব্যয় বিবেচনায় আইনজীবীর পরামর্শে এবং বিপিডিবির ৮৫২তম সাধারণ বোর্ড সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বিপিডিবি এই অর্থ পরিশোধে বিরত থাকে এবং বাংলাদেশের আদালতে মোকদ্দমা বিচারাধীন থাকা অবস্থায় ওই কোম্পানির লন্ডনে আরবিট্রেশন ট্রাইব্যুনালে যাওয়ার বিরুদ্ধে আইনগত আপত্তি উত্থাপন করে।
পরে একপাক্ষিক শুনানি শেষে আইসিসি আরবিট্রেশন ট্রাইব্যুনাল ২০০৩ সালের ৩০ অক্টোবর 'অ্যাওয়ার্ড' ঘোষণা করে এবং স্মিথ কো-জেনারেশন (বাংলাদেশ) প্রাইভেট লিমিটেডের অনুকূলে ১৩.০৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার পরিশোধের নির্দেশ দেয় বিপিডিবিকে। পরিশোধে বিলম্ব হলে ৪ শতাংশ হারে বিলম্ব সুদ পরিশোধের নির্দেশও দেওয়া হয়।
শেষে ২০২৪ সালের ১৯ মে যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া ডিসট্রিক্ট কোর্ট বিপিডিবির বিরুদ্ধে একটি সংশোধিত চূড়ান্ত রায় জারি করে। এই রায় অনুসারে, বিপিডিবিকে ৩১.৭১ মিলিয়ন ডলার পরিশোধের নোটিশ দেওয়া হয়।
গত বছর বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের বার্ষিক সভায় যোগদানের জন্য অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর মনসুর যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করার সময় কলাম্বিয়া ডিসট্রিক্ট কোর্ট এই অর্থ জমা করার জন্য তাদের উদ্দেশ্যে আদেশ জারি করে। আদালত এমনকি তাদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানাও জারি করে। তবে বাংলাদেশ পরে আইনজীবী নিয়োগ করে ওই পরোয়ানা স্থগিত করে।
মধ্যস্থতা প্রক্রিয়া
এরপর বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বিষয়টি আদালতের বাইরে নিষ্পত্তির জন্য স্মিথ কো-জেনারেশন (বাংলাদেশ) প্রাইভেট লিমিটেডের কাছে প্রস্তাব পাঠানো হয়। কোম্পানিটি ওই প্রস্তাব গ্রহণ করে এবং প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস মধ্যস্থতায় নীতিগত সম্মতি দেন।
যুক্তরাষ্ট্রের কলম্বিয়া ডিসট্রিক্ট কোর্টের নিয়োগ করা মধ্যস্থতাকারীদের উপস্থিতিতে স্মিথ কো-জেনারেশন (বাংলাদেশ) প্রাইভেট লিমিটেড এবং বাংলাদেশের অ্যাটর্নি জেনারেল, বিদ্যুৎ বিভাগ ও বিপিডিবির প্রতিনিধিদের মধ্যে পাঁচটি অনলাইন সভা হয়।
এসব সভায় সভায় বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ১৯৯৯ সালে জব্দকৃত স্মিথ কোজেনারেশনের ১.৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ফেরত দেওয়ার মাধ্যমে বিরোধ নিষ্পত্তির প্রস্তাব দেয়া হয়। জবাবে স্মিথ কো-জেনারেশনের পক্ষ থেকে আইসিসি আরবিট্রেশন ট্রাইব্যুনালের চূড়ান্ত রায়ের (১৩.০৬ মিলিয়ন ডলার) পরিপ্রেক্ষিতে ৩১.৭১ মিলিয়ন ডলার এবং মামলাজনিত খরচ বাবদ আরও ১৮.০০ মিলিয়ন ডলার দাবি করা হয়।
এরপর বাংলাদেশ ১.৫ মিলিয়ন ডলারের পাশাপাশি বাংলাদেশের বিদ্যমান আইনের আওতায় বিদ্যুৎ খাতে বিনিয়োগের জন্যও স্মিথ কোজেনারেশনকে আহ্বান জানায়। কিন্তু সেই প্রস্তাব মার্কিন প্রতিষ্ঠানটি গ্রহণ করেনি। সর্বশেষ বাংলাদেশ ১০ মিলিয়ন ডলারে বিরোধ নিষ্পত্তির প্রস্তাব দেয়। জবাবে স্মিথ কোজেনারেশনকে এককালীন ২৫ মিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে বিরোধ নিষ্পত্তি অথবা ২৪ মিলিয়ন ডলার ও দুটি বিদ্যুৎ প্রকল্পে বিনিয়োগের সুযোগের মাধ্যমে নিষ্পত্তির প্রস্তাব দেয়।
অবশেষে বিরোধটি চূড়ান্তভাবে ২০ মিলিয়ন ডলারে মীমাংসা হয় বলে নিশ্চিত করেন অ্যাটর্নি জেনারেল। স্মিথ কোজেনারেশন কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশ ও মার্কিন আদালতসহ বিশ্বের সব আদালত থেকে এ-সংক্রান্ত সকল মামলা প্রত্যাহার ও ভবিষ্যতে আর কোনো মামলা না করার শর্তে সম্মত হয়েছে। গত ২৮ এপ্রিল দুই পক্ষের মধ্যে নিষ্পত্তি চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে। এ চুক্তির আওতায়, সুইজারল্যান্ডের আইনি প্রতিষ্ঠান ব্রাটশি লি.-কে এস্ক্রো এজেন্ট মনোনীত করে স্মিথ কোজেনারেশনকে ২০ মিলিয়ন ডলার দেওয়া হবে।
এদিকে বিপিডিবির আইনি প্রতিষ্ঠান ফলি হোগ এলএলপি-র আইনজীবী ফি বাবদ এ পর্যন্ত ৩ লাখ ৯৬ হাজার ডলার সরকারকে খরচ করতে হয়েছে। ফলে এই মামলা নিষ্পত্তিতে বাংলাদেশ সরকারকে মোট ২.৪ মিলিয়ন ডলার ব্যয় করতে হচ্ছে।
সূত্র:টিবিএস
৫ আগস্ট যাত্রাবাড়ীতে পুলিশের নির্বিচার গুলিতে কমপক্ষে ৫২ জন নিহত হন বলে বিবিসি আই- এর একটি অনুসন্ধানে উঠে এসেছে
গণহত্যার মামলায় শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের আদেশ ১০ জুলাই
শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠনে দ্বিতীয় দিনের শুনানি আজ
আদালত অবমাননার মামলা: শেখ হাসিনার ৬ মাসের কারাদণ্ড